২০২৩ সালে সরকারি ও বেসরকারি খাতে সেবা নিতে গিয়ে ১০ হাজার ৯০২ কোটি টাকা ঘুষ দেলদেন হয়েছে। জাতীয়ভাবে প্রাক্কলিত এই ঘুসের অংক ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ ও জিডিপির ০ দশমিক ২২ শতাংশ। সর্বোচ্চ দুর্নীতি ও ঘুসের হার পাসপোর্ট, বিআরটিএ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায়। এর মধ্যে ভূমিখাতে সেবা পেতে বেশি আর জলবায়ু পরিবর্তন ও দূর্যোগ সহায়তা পেতে কম ঘুষ দিতে হয়েছে।
এই ভয়াবহ অবস্থার লাগাম টানতে দেশের সেবা খাতকে পুরোপুরি ডিজিটাল রূপান্তরের পরামর্শ দিয়েছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) সকালে ধানমন্ডিতে টিআইবি কার্যালয়ে সেবা খাতে দুর্নীতি: জাতীয় খানা জরিপ ২০২৩ প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এই পরামর্শ দেন তিনি।
সেবাখাতে দুর্নীতি কামাতে সেবাখাতে দুর্নীতির সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পাশাপাশি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। এছাড়াও সেবা পুরোপুরি ডিজিটালাইজ করতে হবে যেন সেবাগ্রহীতার সাথে সেবাদাতার প্রত্যক্ষ যোগাযোগের প্রয়োজন না হয় এবং অনলাইনে সেবাগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে যথাযথ প্রচার চালাতে হবে। সব খাতের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে ‘ওয়ান স্টপ’ সার্ভিস চালু করতে হবে এবং তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও পাসপোর্ট অফিস দুর্নীতি রোধে অনেক কথাই বলে; কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যায় না। এমন অভিযোগ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, দুদক সবচেয়ে অকার্যকর ও ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আর সরকারি অফিস বিশেষ করে পাসপোর্টে সিন্ডিকেট করে দুর্নীতি করা হয়, যা থেকে এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও সুবিধা পেয়ে থাকেন।
জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, হয়, সেবা পেতে খানা বা পরিবারপ্রতি ৫ হাজার ৬৮০ টাকা ঘুস দিতে হয়েছে। গড় ঘুসের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি বিচারিক সেবা, ভূমি সেবা ও ব্যাংকখাতে। সেবা পেতে ৭০ দশমিক ৯ শতাংশ পরিবার দুর্নীতি ও ৫০ দশমিক ৮ শতাংশ পরিবার ঘুসের শিকার হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ঘুষ দিতে হয়েছে পাসপোর্ট সেবা নিতে গিয়ে। প্রায় ৭৪.৮ শতাংশ খানা এই খাতে ঘুষ দিয়েছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সেবা নিতে গিয়ে ৮৫.২ শতাংশ, টাকার অঙ্কে সবচেয়ে বেশি ঘুষ দিতে হয়েছে বিচারিক সেবা পেতে। এ খাতে প্রতি খানাকে দিতে হয়েছে গড়ে ৩০ হাজার ৯৭২ টাকা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সেবা নিতে গিয়ে ৭৪.৫ শতাংশ ও বিচারিক সেবা নিতে গিয়ে ৬২.৩ শতাংশ খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে।
বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি ও ঘুষের শিকার খানার হার বরিশাল বিভাগে। এই বিভাগে দুর্নীতির শিকার ৮২ শতাংশ এবং ঘুষের শিকার ৬১.৯ শতাংশ খানা।
জরিপের আওতাধীন খানা ছিল ১৫ হাজার ৫১৫টি। এদের মধ্যে পুরুষ ৫১.৪ শতাংশ, নারী ৪৮.৫ শতাংশ ও তৃতীয় লিঙ্গ ০.১ শতাংশ। খান প্রধানদের মধ্যে ২৩.৪ শতাংশ কৃষি/মৎস্য চাষ।
টিআইবির দশম এই জরিপে সারাদেশের ৮ বিভাগের গ্রাম ও শহরাঞ্চল মিলিয়ে বিভিন্ন পেশার ১৫ হাজার ৫১৫টি খানা (পরিবার) অংশগ্রহণ করেন। এতে ১৮টি সেবাখাতে দুর্নীতির চিত্র তুলে আনা হয়েছে। এগুলো হলো-পাসপোর্ট, বিআরটিএ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, বিচারিক সেবা, ভূমি সেবা, স্বাস্থ্য (সরকারি), স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি), গ্যাস, জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ সহায়তা, বিদ্যুৎ, শিক্ষা (সরকারি ও এমপিওভুক্ত), কৃষি, কর ও শুল্ক, বীমা, ব্যাংকিং, এনজিও (প্রধানত ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণ), অন্যান্য (এমএফএস, ওয়াসা, অনলাইন শপিং ইত্যাদি)।
টিআইবি জানিয়েছে, এসব খাতের সেবা গ্রহণে গ্রমাঞ্চলে ৭১.৮ শতাংশ, শহরাঞ্চলে ৬৯ শতাংশ দুর্নীতি হয়েছে। এর মধ্যে পাসপোর্ট, বিআরটিএ, আইশৃঙ্খলা, বিচারিক ও ভূমি সেবা পেতে বেশি দুর্নীতি হয়েছে। এর মধ্যে পাসপোর্টে গ্রামে ৮৮.৬, শহরে ৮১.০, বিআরটিএতে গ্রামে ৮৪.০, শহরে ৮৬.৬, আইনশৃঙ্খলায় গ্রামে ৭৫.১, শহরে ৭৩.৪, বিচারিক সেবায় গ্রামে ৬৩.৪, শহরে ৬০.১, ভূমি সেবা পেতে গ্রামে ৫১.৫, শহরে ৪৯.৮ শতাংশ দুর্নীতি হয়েছে।