দেশের ইন্টারনেট ব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন করতে দেশের তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবলের বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর মাধ্যমে ১৩২০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউদথের জন্য সংশোধিত চুক্তি অনুযায়ী সিমিইউ -৬ কনসসোর্টিয়ামকে মোট ৯৪৬ দশমিক ২৪ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। এর মধ্যে চলতি সপ্তাহে দ্বিতীয় দফায় পরিশোধ করা হলো ১৫ মিলিয়ন ডলার। এর আগে পরিশোধ করা হয়েছিলো আরও ১৭ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ দুই দফায় এ পর্যন্ত জমা দেয়া হয়েছে মোট ৩২ মিলিয়ন ডলার। এছাড়াও ৭ মিলিয়ন ডলারের টাকা সোনালী ব্যাংকে পাঠানোর জন্য জমা দেয়া আছে; যা আগামী সপ্তাহেই পরিশোধিত হবে।
এর মাধ্যমে তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবলের সক্ষমতা দ্বিগুণ বাড়বে এবং ব্যয় অর্ধেকেরও কমে নেমে আসবে বলে জানিয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার।
তিনি বলেছেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে সাবমেরিন ক্যাবলের ভূমিকা অপরিহার্য। বাংলাদেশকে সুখী সমৃদ্ধ, উন্নত বৈষম্যহীন বা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে এই ডিজিটাল সংযুক্তির কোন বিকল্প নেই। সাবমেরিন ক্যাবল সংযুক্তি হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তির হাইওয়ে। তথ্যপ্রযুক্তির এই মহাসড়কে বাংলাদেশ বর্তমানে সাউথ ইস্ট এশিয়া-মিডল ইস্ট-ওয়েস্টার্ন ইউরোপ-৪ এবং সাউথইস্ট এশিয়া-মিডল ইস্ট-ওয়েস্টার্ন ইউরোপ-৫ নামক দু’টি সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে যুক্ত রয়েছে।
মন্ত্রী আরো বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ৭ এপ্রিল ২২ অনুষ্ঠিত ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের তৃতীয় সভায় তৃতীয়তো বটেই চতুর্থ সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপনের নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবলের সক্ষমতা দ্বিগুণ করে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে অনেকটা এগিয়ে থাকলাম। বহুল প্রত্যাশিত প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সি-মি-উই-৬ কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড মেইটেনেন্স অ্যাগ্রিমেন্ট এবং কনসোর্টিয়ামের সরবরাহকারীদের সঙ্গে গত সেপ্টেম্বরে চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবলে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়ার আনুষ্ঠানিক এই কার্যক্রম শুরু হয়।
সোমবার ( ৮ আগস্ট) সচিবালয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল সংযোগ বাস্তবায়ন সংক্রান্ত এক পর্যালোচনা সভায় এসব কথা বলেন মন্ত্রী।
বৈঠকে বিএসসিসিএল-এর ধারাবাহিক আর্থিক অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার স্মরণ করিয়ে দেন, দেশে ২০০৮ সালের ১ জুলাই থেকে বাংলাদেশে সাবমেরিন ক্যাবলের বাণিজ্যিক পরিচালনা শুরু হয়। ২০০৮ সালে ব্যান্ডউদথ ক্যাপাসিটি ছিলো ৪৪.৪৬ জিবিপিএস। ২০১৮ সাল পর্যন্ত ব্যান্ডউইথ ক্যাপাসিটি ১৮০০ জিবিপিএস এ উন্নীত হয় এবং ২০২২ সালে অর্থাৎ গত চার বছরে তা ৩৩৭০ জিবিপিএস-এ উন্নীত হয়েছে। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ব্যান্ডউদথ ব্যবহৃত হয় ১০ জিবিপিএস এবং ২০১৮ সাল পর্যন্ত তা বৃদ্ধি পেয়ে ৬১৮ জিবিপিএস- এ উন্নীত হয় এবং গত চার বছরে সাবমেরিন ক্যাবলের ব্যান্ডউদথ ব্যবহার ২৪২০ জিবিপিএস- এ উন্নীত হয়েছে।
তিনি বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানির আয় ২০০৮- ৯ অর্থবছরে ৪৩.৫৯ কোটি থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৪৪ দশমিক ৮৫ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ এক দশকে বিএসসিসিএল এর আয় বেড়েছে ৩০০ কোটি টাকারও বেশি।
এ বিষয়ে ‘সাবমেরিন ক্যাবলকে দেশের অত্যন্ত অপরিহার্য ডিজিটাল অবকাঠামো’ উল্লেখ করে মোস্তাফা জব্বান বলেন, বিনামাশুলে ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে সাবমেরিন ক্যাবল সংযোগের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে তৎকালীন বিএনপি সরকার বাংলাদেশকে ১৪ বছর তথ্যপ্রযুক্তি দুনিয়া থেকে পিছিয়ে রাখে। ২০০৮ সালে ঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির হাত ধরে সেই পশ্চাদপদতা অতিক্রমই বাংলাদেশ কেবল করেনি বরং হাওর, দ্বীপ, চরাঞ্চল ও দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলসহ দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড সংযোগ পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।
ডিজিটাল প্রযুক্তি বিকাশের এই অগ্রনায়ক বলেন, দেশে ২০০৮ সালে মাত্র ৮ জিবিপিএস ইন্টারনেট ব্যবহৃত হতো এবং ব্যবহারকারী ছিল মাত্র ৭ লাখ। ২০২০ সালে কোভিড শুরুর প্রাক্কালে দেশে ১ হাজার জিবিপিএস ইন্টারনেট ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে তা বেড়ে ৩ হাজার ৪৪০ জিবিপিএসে উন্নীত হয়েছে। ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১৩ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জন্য তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল সংযুক্তি ডিজিটাল প্রযুক্তি দুনিয়ায় বাংলাদেশের আরো একটি ঐতিহাসিক অর্জন।
তিনি বলেন, আগামী দিনে ডিজিটাল সংযুক্তির বর্ধিত চাহিদা পূরণের মাধ্যমে ডিজিটাল দুনিয়ার সঙ্গে সি-মি-উই-৬ নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ স্থাপনে অভাবনীয় অবদান রাখবে। ২০০৬ সালের প্রথমার্ধে দেশে প্রথম সাবমেরিন ক্যাবল কমিশনিং করা হয়। ২০২৫ সালে সিমিইউ-৬ সংযোগ চালু হওয়ার পর দেশে ২০৪০০জিবিপিএস-এরও বেশি আন্তর্জাতিক ব্যান্ডউইথ সরবরাহ করা সম্ভব হবে। কেবল দেশের চাহিদা নয় এই কোম্পানী এখন বিদেশেও ব্যান্ডউইথ রপ্তানী করছে। ইতোমধ্যে ভারতের আগরতলায় ২০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইদথ রফতানি করা হচ্ছে। ভারতের আসাম রাজ্যের রাষ্ট্রীয় একটি প্রতিষ্ঠান তামাবিল সীমান্ত দিয়ে মেঘালয় ও আসাম রাজ্যের জন্য সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে ব্যান্ডউইথ সরবরাহের জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। এছাড়া ভুটান বাংলাদেশ থেকে ১০ জিবিপিএস ব্যান্ডউদথ আমদানি করার জন্য লেটার অব ইনটেন্ট প্রদান করেছে।
তিনি জানান, বিএসসিসিএল দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবলের পশ্চিম দিকের তথা ইউরোপের দিকের অব্যবহৃত ২০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ দীর্ঘমেয়াদে লিজ দেওয়ার জন্য মালেয়েশিয়ার সাথে চুক্তি স্বাক্ষর চুড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সৌদি আরবে আমরা ৬০০ জিবিপিএস এবং ফ্রান্সে ১৩ জিবিপিএস ব্যান্ডউদথ রপ্তানি করছি। এছাড়াও সৌদি টেলিকমও আরও ব্যান্ডউইথ নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।