পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজের গুণগত মানে কোনও আপস করা হয়নি। এই সেতু নির্মিত হয়েছে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও উপকরণে। সর্বোচ্চ ১২২ মিটার গভীর পর্যন্ত এই সেতুর পাইল বসানো হয়েছে। ভূমিকম্প প্রতিরোধ বিবেচনায় ব্যবহৃত হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। আর প্রযুক্তি-প্রৌকশলে পাঁচটি বিশ্বরেকর্ড স্পর্শ করেছে পদ্মা সেতু। গভীরতম পাইল ও পেন্ডুলাম বিয়ারিং এর অন্যতম।
গাইড বান্ড উইথ ফলিং অ্যাপ্রোন
যেকোনো সেতু নির্মাণের প্রথম ধাপ হচ্ছে নদীশাসন। এ জন্য ছয় দশমিক পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু প্রকল্পে প্রমত্তা পদ্মাকে শাসন করতে সবর্শেষ প্রযুক্তির প্রকৌশল অবলম্বন করা হয়েছ। এর নাম গাইড বান্ড উইথ ফলিং অ্যাপ্রোন। এ প্রকৌশলে আধুনিক ড্রেজার ব্যবহার করে ২০ থেকে ২৫ মিটার পর্যন্ত খনন করে ঢাল তৈরি করা হয়। ঢালের ওপর ফেলে রাখা হয় ভারী পাথর কিংবা জিও টেক্সটাইলের বালুভর্তি ভারী ব্যাগ। ফলে ওই অংশের নরম মাটি যদি কোনো কারণে ভেঙে নিচে সরেও যায়, তাহলে স্থাপিত ভারী পাথর বা ব্যাগ আরও নিচে পড়ে গিয়ে শক্ত স্তর সৃষ্টি করে, যা নদীর গতিপথ পরিবর্তনে বাধার সৃষ্টি করে।
প্রকৌশলবিদদের মতে, ড্রেজার দিয়ে স্টিল আর কংক্রিটের তৈরি দ্বিতল বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণকালে সর্বাধুনিক ড্রেজার ব্যবহার করে খনন করা যেত সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ১৮ মিটার। প্রযুক্তির উন্নতির ফলে পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ মিটারে। এছাড়াও সহজে নদীর গতিপথ ও স্বভাব নির্ধারণ করতে নদীশাসনের সময় নদীর পাড়ে যে পাথর বসানো হয়, সেগুলো সম্পূর্ণভাবে জিপিএস দিয়ে হিসাব করে বসানো হয়েছে। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে নদীশাসনে আর পাইলিংয়ের কাজে জিপিএস প্রকৌশল ব্যবহার করা হয়েছে। পাশাপাশি সেতুর ডিজাইনের সময় নদীর গতিপথ পরিবর্তনের চিত্র স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করে বানানো হয়েছে।
পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজে বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য ড. আইনুন নিশাত এর ভাষায়, পদ্মা নদী একটি অ্যালুভিয়াল নদী অর্থাৎ পলল-শিলার মধ্য দিয়ে এই নদী একে বেঁকে সাপের মতো প্রবাহিত হচ্ছে। এটি খামখেয়ালি নদীও বটে কারণ এর চরিত্র বিচিত্র রকমের। এর পাড়ও ভাঙে খুব বেশি। এরকম বিশাল ও প্রমত্ত একটি নদীর ওপর এতো বড় সেতু নির্মানের কাজ প্রকৌশলগত দিক থেকে ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ব্যবহার করা হয়েছে তার এক একটির ওজন ৮০০ কেজি থেকে এক টন পাথর। পৃথিবীর বড় বড় তিনটি ড্রেজার আনা হয়েছিল। সেগুলোর মাধ্যমে নদীর তলায় ৮০০ কেজির জিওব্যাগে তুলনামূলকভাবে মোটা বালি ভরে বটম লেয়ার বা স্তর তৈরি করা হয়েছে।
স্ক্রিন গ্রাউটিং
নদী শাসনের পর আসে পাইলিং। এক্ষেত্রেপদ্মা সেতুতে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। সেই প্রযুক্তি দিয়েই পদ্মায় পাইলিং খনন করা হয়েছে প্রায় ১২২ মিটার। এটি নদীতে সেতুর কাঠামো নির্মাণে বিশ্বের গভীরতম পাইলিং। এটি প্রায় ৪০ তলা বিল্ডিঙের উচ্চতার সমান। এখানে ৩ মিটার ব্যাসের ইস্পাতের টিউবকে কিছুটা বাঁকাভাবে হ্যামার দিয়ে মাটিতে ঢোকানো হয়েছে। পাইলিংয়ের উপরিভাগে স্ক্রিন গ্রাউটিং করে (অতিমিহি সিমেন্টের স্তর) পাইলের ওজন বহনক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। পিলার এবং স্টিলের কাঠামোর সংযোগস্থলে ১০০ টনের বিয়ারিং বসানো হয়েছে। সাধারণত সেতুতে দুটি করে বিয়ারিং বসানো হয়। কিন্তু পদ্মা সেতুতে দুই স্প্যানের সংযোগ স্থলে তিনটি করে বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে।
পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আব্দুল কাদের জানান, পদ্মা নদীর গভীর তলদেশে কাদামাটির স্তর থাকায় নতুন নকশা করতে হয়েছে। এই নকশায় ১ ও ৪২ নম্বর খুঁটির ১৬টি করে মোট ৩২টি পাইল করা হয়। আর ২২টি খুঁটিতে সাতটি করে মোট ১৫৪টি পাইল এবং ১৮টি খুঁটিতে ছয়টি করে মোট ১০৮টি পাইল রাখা হয়।
ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং
শতবছরের টেকসই প্রযুক্তির পাশঅপাশি ভূমিকম্প প্রতিরোধ করার জন্য পদ্মা সেতুতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। ভূমিকম্পের সময় মাটিতে যে কম্পন সৃষ্টি হয় তার সবটুকু যাতে সেতুর উপরিকাঠামোতে যেতে না পারে সেজন্য ব্যবহার করা হয়েছে ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং বা এফপিবি প্রযুক্তি। এটি ব্যবহার করায় ভূমিকম্পের সময় সেতুর পাইলিং নড়াচড়া করলেও মূল সেতুর কাঠামোয় এর কোনো প্রভাব পড়বে না। ডিজাইন অনুসারে পদ্মা সেতু প্রায় ১০ হাজার টন লোড সামলাতে সক্ষম। কিন্তু বিশ্বে এ ধরনের পরীক্ষায় মাত্র ৮ হাজার টন লোডের জন্য পরীক্ষা করা যায়। বাকি অংশ স্কেল মডেলে পরীক্ষা করা হবে। এফপিবি প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে পদ্মা সেতুর নির্মাণ প্রায় ১০ কোটি মার্কিন ডলার কমে গেছে। এটি ব্যবহার না করলে প্রতি পিলারে ৬টির পরিবর্তে ৮টি করে পাইলিংয়ের লাগত। মূলত বিল্ডিংয়ের ভার বহন, কাঠামোর চাপে যাতে মাটি সরে না যায় এবং ক্ষয় না হয়ে যায় সে কারণে পাইলিং করা হয়।
মূল অবকাঠামোর পাশাপাশি পদ্মা সেতুতে রয়েছে অত্যাধুনিক সিসি ক্যামেরা। সাধারণ আলোক সুবিধার পাশাপাশি সেতুতে রয়েছে আলোকসজ্জা ও সৌন্দর্য বর্ধনে রয়েছে আর্কিটেকচার লাইটিং। স্বয়ংক্রিয় টোল আদায়ে ব্যবহৃত হয়েছে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন (আরএফআইডি)। সেতুর দুই প্রান্তে বসানো হয়েছে মোট ১৪টি ইলেক্ট্রনিকস টোল কালেকশন (ইটিসি) বুথ। সেতুতে থাকছে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ পরিবহন সুবিধা।