দেশের মানুষের ওষুধ এবং স্বাস্থ্য খাতের সঙ্গে জড়িত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সামগ্রিক ব্যয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭৩ শতাংশ। যা বিশ্বব্যাপী একই খাতে গড় ব্যয়ের চেয়ে ১৭ শতাংশ বেশি। এর মধ্য নিম্ন আয়ের ৪০ শতাংশ মানুষের আয়ের ১০০ টাকার মধ্যে ২০ টাকা চলে যায় ওষুধ কিনতে। আর স্বাস্থ্যজনিত সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয় ক্যান্সার এবং কিডনি রোগে।
শনিবার (২৩ নভেম্বর) রাজধানীর বনানীতে শেরাটন হোটেলে বেসরকারি সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড) আয়োজিত ‘দি ইকোনমিক ইমপ্যাক্ট অব এলডিসি গ্রাজুয়েশন অন বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড ইটস ইমপ্লিকেশন ফর ড্রাগ প্রাইসেস ইন দি লোকাল মার্কেট’ শীর্ষক সেমিনারে মূল প্রবন্ধে এসব কথা তুলে ধরেন র্যাপিড চেয়ারম্যান ড. এম এ রাজ্জাক।
অপরদিকে ঢাকা চেম্বার অডিটোরিয়ামে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) একই দিনে অনুষ্ঠিত ‘স্বাস্থ্য খাতে বিদেশমুখিতা কমাতে দেশীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি’ বিষয়ক সেমিনারে জানানো হয়, প্রতিবছর স্বাস্থ্যসেবায় বিদেশে চলে যায় ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৪৮ হাজার কোটি টাকা। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে ডিসিসিআই ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি মালিক তালহা ইসমাইল বারী জানান, স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের মাথাপিছু ব্যয় ১১০ মার্কিন ডলার, যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে ব্যয় হয় ৪০১ মার্কিন ডলার। ০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল ৩০ হাজার ১২৫ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের মাত্র ৩.৭৮ শতাংশ। তিনি জানান, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতার কারণে দেশের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী বিশ্বের অন্যান্য দেশের সেবা নিয়ে থাকে এবং ২০১২ সালে বিদেশে স্বাস্থ্য সেবা নেওয়ায় বাংলাদেশিদের ব্যয়ের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
স্বাগত বক্তব্যে ডব্লিউটিও-এর তথ্য তুলে ধরে বাংলাদেশের ৪৯ শতাংশ মানুষই মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা না পওয়ার বিষয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেন ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ। এজন্য এখাতের উন্নয়নে বিশেষ করে উন্নত অবকাঠামো ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিতকরণ ও স্বাস্থ্যখাতের সব ধরনের লাইসেন্স প্রাপ্তি ও নবায়নের প্রক্রিয়াগত জটিলতা নিরসনে ডিজিটাল ব্যবস্থা প্রবর্তনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিসিয়ান্স অ্যান্ড সার্জন্স-এর সেক্রেটারি ডা. আবুল বাসার মো. জামাল জানান, বাংলাদেশে ১ লাখ ৩৪ হাজার চিকিৎসক রয়েছে এবং এর মধ্যে মাত্র ৩৩ হাজার সরকারি চিকিৎসক। তবে এটা সন্তোষজনক যে এখানে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১০ হাজারের বেশি বিদেশি মেডিকেল শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে।
সেমিনারে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্টার ডা. মো. লিয়াকত হোসাইন, বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি এবং সমরিতা হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এ বি এম হারুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব হেলথ ইকোনমিক্সের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আব্দুল হামিদ, বিএসএমএমইউ-এর প্রসূতি ও স্ত্রীরোগবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল এবং বাংলাদেশ সোসাইটি অব ইমার্জেন্সি মেডিসিনের সেক্রেটারি জেনারেল ডা. মীর সাদউদ্দিন আহমেদ প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন।
দিনের অপর সেমিনারে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের প্রতিবেদন তুলে ধরে র্যাপিড চেয়ারম্যান ড. এম এ রাজ্জাক জানান, মানুষের স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বাড়ার পেছনে বড় কারণ- গড় হিসাবে ১৬ দশমিক ২ শতাংশ পরিবারে কমপক্ষে একজন ক্যান্সার কিংবা কিডনি রোগী রয়েছে। এ দুটো রোগের খরচ সাধারণত বেশি থাকে।
তিনি বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর দেশের ওষুধসহ বিভিন্ন পণ্যের দান বেড়ে যাবে। যার নেতিবাচক প্রভাব পরিবারের ওপর পড়বে। এতে দারিদ্র্য বেড়ে যাবে এমন শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য ও সেবা খাতে ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি অর্থায়ন বৃদ্ধি করতে হবে।
ড. এম এ রাজ্জাক আরো জানান, দেশে গ্রাজুয়েশনের পর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিটিও) শর্তের কারণে ওষুধ পণ্য রপ্তানিতে বিদ্যমান প্রণোদনা থাকবে না। এতে ওষুধ খাত থেকে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ রপ্তানি আয় কমে যাবে। তবে এ খাতের বৈদেশিক আয় দেশের মোট রপ্তানি আয়ের তুলনায় একেবারে কম হওয়ায় অর্থনীতিতে তেমন প্রভাব পড়ার কথা নয়। তবে গ্র্যাজুয়েশনের পর অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রিডেন্টস (এপিআই) ৯৫ শতাংশ দেশীয়ভাবে উৎপাদন হবে। যা এ খাতের স্বাভাবিক সরবরাহ বিঘ্নিত ঘটা থেকে সুরক্ষায় ভূমিকা রাখবে।
র্যাপিড চেয়ারম্যান বলেন, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন ২০২৬ সালের নভেম্বরে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু পণ্যের প্যাটেন-ফ্রি সময় বাড়তি তিন বছর বহাল থাকবে। এসময় দক্ষতা উন্নয়ন ও নতুন এলডিসি উত্তর পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর সুযোগ হিসেবে বিবেচনায় নিতে হবে। পাশাপাশি ওষুধ উৎপাদনে এপিআই আমদানি কমাতে হবে। যা স্থানীয়ভাবে ওষুধ উৎপাদনে সহায়তা করবে। একটা সময় পরে বিশ্ববাজারের বাংলাদেশের উৎপাদিত ওষুধ পণ্যের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে এবং এ খাতের বৈদেশিক আয় বেড়ে যাবে। সবকিছু পরিকল্পনা ও লক্ষ্য অনুযায়ী করা সম্ভব হলে দেশে ওষুধের দাম না বেড়ে অপরিবর্তিত থাকবে।
অনুষ্ঠানে র্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফের সঞ্চালনায় প্রধান অতিথি ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে ইয়াসির সিদ্দিকী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা প্রমুখ।
জিএসকে বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি মাসুদ খান প্যানেল বক্তা হিসেবে বলেন, ওষুধের প্যাটেন্ট এবং ফার্মাসিউটিক্যাল যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলার ব্যয় হচ্ছে।