বিজ্ঞানের রাজ্যে। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের কাছে সিরিজ গেমটি বিজ্ঞান পাঠ্যকে খেলনায় পরিণত করে। আর এর মাধ্যমেই এক লাফে খ্যাতি পায় ড্রিম ৭১। ২০১৫ সালের অক্টোবরে এটুআইএর সহযোগিতায় এই গেমটি উপহার দেন ড্রিম ৭১ এর প্রতিষ্ঠাতা রাশাদ কবির। কুয়েট থেকে ট্রিপল‘ই’ বিষয়ে স্নাতকত্তর শেষ করেই গড়ে তোলেন এই কোম্পানিটি। এর আগে অবশ্য পারিবারিক প্রতিষ্ঠান বিসিএমসি ফাউন্ডেশন লিমিটেডের পরিচালক হিসেবে সময় দিয়েছেন ছাত্রাবস্থাতেই। কিন্তু সেখানে থিতু হননি। গড়ে তুলেছেন নিজের প্রতিষ্ঠান। গেম দিয়ে শুরু করলেও এখন বিশ্ব বাজারে নানা সল্যুশন দিয়ে বাংলাদেশের পতাকা বহন করছেন ১০টির মতো দেশে। জাপানেও আছে পার্টনার কোম্পানী,আফ্রিকাতেও আছে কোম্পানীর ভালো পদচারণা। তবে এর বাইরেও গেম অ্যাপ ‘টিন ট্রিপ্রেনিউর ফিউশন’’ দিয়ে মাত করেছেন যুক্তরাজ্যের ৬০০ এর অধিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের। বিশ্বজুড়ে সাড়ে ৩ লাখের ওপর বিক্রি হয়েছে এই গেমটি। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেট অ্যাপেরও রূপকার বেসিস জাপান ফোকাস গ্রুপের এই আহ্বায়ক। সাক্ষাৎকারে তথ্যপ্রযুক্তিতে ভবিষ্যত ক্যারিয়ার নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।
কীভাবে শুরু হয়েছিলো ড্রিম ৭১ এর স্বপ্ন?
‘বিজ্ঞানের রাজ্য’ গেম দিয়ে শুরু করেছিলাম ২০১৫ সালে। তখন গেম দিয়ে শুরু করলেও পরে এন্টারপ্রাইজ সল্যুশনে যাই।
বিদায়ী বছরে কী পরিমাণ রেমিটেন্স আনলেন?
বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আয় করেছে ড্রিম ৭১। পিডব্লিউডি, এটুআই, আইসিটি ডিভিশন, ইপিবি’র সঙ্গে যেমন কাজ করেছি তেমনি ক্যামেরুন, কেনিয়া ও নাইজেরিয়ায় এ বছর কাজ করেছি। পাশাপাশি আমরা আফ্রিকা ছাড়াও জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, নেদারল্যান্ডস, আরব আমিরাতেও সফটওয়্যার রপ্তানি করছে। সব মিলিয়ে গত বছরে ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি।
গেম দিয়ে শুরু করেছিলেন। কিন্তু অপার সম্ভাবনা থাকার পরও কেন এই জায়গাটার ওপর নির্ভর করা যাচ্ছে না?
প্রথম তিন বছর আমরা মোবাইল গেম নিয়ে কাজ করি। এটুআইয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের সর্ব প্রথম এড্যুকেশনাল গেম ‘বিজ্ঞানের রাজ্যে’ আমাদের তৈরি গেম। কিন্তু এখন গেম থেকে যে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছি বা দূরে সরে আসছি ব্যাপারটি সেরকম না। আমরা এখনো কাজ করছি। তবে সীমিত পরিসরে।
বাংলাদেশে মোবাইল/পিসি গেম শিল্প গড়ে ওঠার জন্য কী কী অন্তরায় রয়েছে?
গেমের ক্ষেত্রে আমাদের ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটি রয়েছে সেটি হলো আমাদের দক্ষ জনশক্তি। গেমের জন্য একটি দল তৈরি করতে হলে ৪০-১০০ লোক থাকলে হবে না। কমপক্ষে এক হাজার-দুই হাজার রিসোর্স দরকার হয়। বেশি রিসোর্স থাকলে মানসম্পন্ন রিসোর্স খুঁজে নেয়াটা সহজ হয়। কিন্তু এই জায়গাতে আমাদের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। কারণ, স্কিল্ড রিসোর্স নাই। এক্সপেরিয়েন্স রিসোর্স নেই। এটাই আমাদের জন্য গেমিং শিল্পের বড় অন্তরায়। বিশ্বব্যাপী আপনি যদি চিন্তা করেন, গেমের বাজারটি কিন্তু গত ১০-১২ বছর আগে যেমন ছিলো তেমনটা নেই। একটা সময় ছিলো অ্যাপ স্টোরে গেম আপলোড করলে সেখান থেকে ভালো রাজস্ব আয় হতো। কিন্তু এখন আর সেই দিন নেই। এখন প্রতিযোগিতা অনেক বেড়ে গেছে। বিশ্বের সব জায়গা থেকেই গেম আপলোড হচ্ছে। তাই কোয়ালিটি গেম তৈরি করে তা থেকে রেভ্যুনু জেনারেট করাটা কঠিন হয়ে গেছে।
শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠায় আমাদের প্রযুক্তি খাতের প্রস্তুতি কোন পর্যায়ে?
আমাদের আইটি খাত যথেষ্ট ম্যাচুউরিটি এসেছে। ২০০৯ সালে আমাদের রপ্তানি ছিলো ২৬ মিলিয়ন ডলার এখন তা এক বিলিয়ন অতিক্রম করেছে। পাশাপাশি গত কয়েক বছরে দেশে স্টার্টআপ সংস্কৃতি বেশ ভালো অবস্থানে পৌঁছেছে। আমার বিশ্বাস, আগামী ৩-৪ বছরের মধ্যে সফটওয়্যার খাতেও ওয়ালটন ও সিম্ফনির মতো কোম্পানি বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হবে। অন্তত ৬-৮টি কোম্পানি দাঁড়িয়ে যাবে যেগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে ভালো করবে। আমাদের দেশে এখন ২০টি মতো কোম্পানি আছে যাদের টার্ন ওভার একশ’ কোটি টাকার ওপরে।
ব্লক চেইন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাজার ধরতে বাংলাদেশের বর্তমান প্রচেষ্টা কোন দিকে এগুচ্ছে?
আগামী ৫-১০ বছরটি হবে ব্লক চেইন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগ। ইতিমধ্যেই আমরা চতুর্শ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছি। এটা বাংলাদেশের সামনে একটি অপার সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। আপনি জানেন আমরা দীর্ঘ ৩ বছরের বেশি সময় জাপান বাজারে কাজ করে যাচ্ছি। সেখানে যখন আমার কাজ করতে যাই, সেখানে সবসময় আমরা এআই, ব্লক চেইন নিয়ে কাজের ফরমাশ বেশি পেয়ে থাকি। অলরেডি আমরা এটা নিয়ে কাজ শুরু করেছি।
কেমন দেখছেন আগামীর প্রযুক্তি খাতের ক্যারিয়ার?
আগামী ৫-১০ বছরে দেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কর্মসংস্থানে একটা বড় সুযোগ তৈরি করবে। সরকার ইতিমধ্যেই ৩ হাজার সরকারি সেবা অটোমেশনের কাজ হাতে নিয়েছে। আর এই কাজগুলো বাংলাদেশের কোম্পানিইগুলোই করবে। এছাড়াও বাংলাদেশের বেশ কিছু কোম্পানি এখন আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করেছে। সব মিলিয়ে দেশের কোম্পানিগুলোর কাজ তুলতে প্রয়োজন হবে প্রচুর তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী। সবচেয়ে বড় কথা বাংলাদেশে এই দশকে চাকরি বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে এআই। তবে এক্ষেত্রে চাকরি হারানোর সংখ্যায় কোনো প্রভাব ফেলবে না। তবে জন ন্যাচর চেঞ্জ হবে। ফলে আমাদের এআই প্রশিক্ষণ বিষয়ে বেশি নজর দিতে হবে।
কারিকুলাম কতটুকু শিল্প বা ক্যারিয়ার বান্ধব?
আমাদের পাবলিক ও প্রাইভেট কারিকুলামের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই বাজার চাহিদা অনুযায়ী পাবলিক ইউনিভার্সিটি উপযুক্ত কারিকুলাম তৈরি করতে পারেনি। এটা প্রত্যাশিতও বটে। কেননা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কোথাও এতটা দ্রুত মুভ করে না। গত দুই-তিন বছরে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ভালো করছে। ৪-৬ মাসের ইন্টার্নশিপ দিয়ে তারা ছাত্রদেরকে শিল্প বা ক্যারিয়ার উপযোগী করে তুলছে।
অলিম্পিয়াড গুলোতে কিশোরের ভালো করছে। তাদেরকে কী ভাবে ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা যায়?
অলিম্পিয়াড বিজয়ীরাই আমাদের বাংলাদেশের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। তাই তাদেরকে ইন্ডস্ট্রিতে অনবোর্ড করতে পারার মুন্সিয়ানার মধ্য দিয়ে আমরা নতুন ভোর দেখতে পাবো।
লক্ষ্য বাস্তবায়নের বাঁকে কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে?
লক্ষ্য বাস্তবায়নের বাঁকে আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মিড লেভেল রিসোর্স এর ঘাটতি। ইন্ডাস্ট্রির চাহিদা অনুযায়ী আমাদের পর্যাপ্ত রিসোর্স নেই। এই যেমন প্রোজেক্ট ম্যানেজার, সিস্টেম অ্যানালিস্ট, বিজনেস অ্যানালিস্ট এই রিসোর্সগুলোর যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। কর্মীদের অভিজ্ঞতা বারার সাথে সাথে এটা সময়ের সাথে সাথে পূরণ হবে। তবে এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক বাজারে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করতে হলে মার্কেটিং রিসোর্স তৈরিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া দরকার।
ক্রস বর্ডার ইকোনোমিতে আমাদের প্রযুক্তি খাত কতটা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে?
ক্রস বর্ডার ইকোনোমিতে আমাদের প্রযুক্তিতে আমাদের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা জানুয়ারিতেই ভুটানে যাচ্ছি। সেখানে আইসিটি মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এবং লেবার অ্যান্ড হিউম্যান রিসোর্সেস এর সঙ্গে চুক্তি করতে যাচ্ছি। আমরা অনেক দিন ধরেই কাজ করছি। অলরেডি ১০টি দেশে আমাদের সফটওয়্যার রপ্তানি হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কাজ করার এটা আমাদের জন্য একটা হাই টাইম। বিশেষ করে আফ্রিকার বাজারকে আমাদের করায়ত্ব করতে হবে।
ড্রিম ৭১ এর আগামীর স্বপ্ন কি?
ই-গভর্নেন্স খাতে পাইওনিয়ার হয়ে একটি বৈশ্বিক ব্র্যান্ডে পরিণত হওয়া।