দৈনন্দিন জীবনে যাতায়াতসহ মানুষের নানা কাজকে সহজ করে দিয়েছে ম্যাপ। বর্তমানে বিশ্বে বহুল ব্যবহৃত ডিজিটাল ম্যাপ হলো গুগল ম্যাপ। বাংলাদেশে ডিজিটাল ম্যাপিংয়ের যাত্রা শুরু হয় কম্পিউটার ভিত্তিক ম্যাপিং সিস্টেম জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম বা জিআইএস এর মাধ্যমে। আর এই সিস্টেম তৈরিতে নেতৃত্ব দেন তৎকালীন স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল বিভাগের প্রধান কামরুল ইসলাম সিদ্দিক। তাঁকে বাংলাদেশের ডিজিটাল ম্যাপিংয়ের পথিকৃৎ বলা হয়।
কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের সাক্ষাতকারের মাধ্যমে ২০০২ সালের ৩১ অক্টোবর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন বা বিবিসি। প্রতিবেদনটি তৈরি করেন আলফ্রেড হার্মিদা। চলুন, আমরা সেই প্রতিবেদনটির বাংলা অনুবাদ পড়ে নিই।
‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়বে স্যাটেলাইট ম্যাপিং’
বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্থ দেশগুলোর অন্যতম হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া বাংলাদেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ে অমূল্য হিসেবে প্রমাণিত হচ্ছে দেশটির ডিজিটাল ম্যাপস। এই ম্যাপসটি একটি কম্পিউটারাইজড ন্যাশনাল ডাটাবেজের সাথে যৌথভাবে ব্যবহার করা হয় যাতে কোথায় সড়ক কিংবা স্কুল নির্মাণ করা উচিত সেই সিদ্ধান্ত নেয়া যায়।
এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য হলো, রাজনীতিবিদদের চাহিদার পরিবর্তে স্থানীয়দের প্রয়োজন বুঝে অগ্রাধিকারভিত্তিতে উন্নয়ন এবং খরচের মতো কঠিন বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
এই উদ্যোগের পথিকৃৎ কামরুল ইসলাম সিদ্দিক বলেন, পরিকল্পনা এবং অগ্রাধিকার বিষয়গুলো চিহ্নিত করার জন্য এটি একটি অসাধারণ পরিকল্পনা টুল হিসেবে রূপ নিয়েছে। এর তথ্য উন্মুক্ত, স্বচ্ছ এবং সকলেই পেতে পারে।
রাজনৈতিক চাহিদা
জনাব সিদ্দিক স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল বিভাগের প্রধান হিসেবে ১৮ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন এবং জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেমস (জিআইএস) নামের কম্পিউটারভিত্তিক ম্যাপিং সিস্টেম তৈরির বিষয়টি দেখেছেন।
জিআইএস ডাটাবেজে সংরক্ষিত তথ্য ব্যবহার করে এবং ম্যাপে তুলে ধরেছেন। ফলে এর মাধ্যমে এটি সহজে পড়া এবং বোঝা যায়।
বর্তমানে (মরহুম) অবসরপ্রাপ্ত জনাব সিদ্দিক দেখেছেন যে, এই সিস্টেমটি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজে লাগানো যেতে পারে।
তিনি বলেন, সড়ক অবশ্যই উন্নয়ন কেন্দ্র অথবা স্থানীয় বাজারকে সংযুক্ত করবে, শুধুমাত্র রাজনীতিবিদের বাড়ি নয়। আমরা এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে, আবেদনটি একজন রাজনীতিবিদের পরিবর্তে স্থানীয় চাহিদা পূরণ করছে কিনা।
হস্তক্ষেপ
দুর্নীতি অতীতেই বাংলাদেশকে জর্জরিত করেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সাম্প্রতিক প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দ্বিতীয়বারের মতো পাবলিক সেক্টরের দুর্নীতিতে বাংলাদেশ শীর্ষস্থানে রয়েছে।
বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে অতীতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কীভাবে বাধাগ্রস্থ করেছে তা বর্ণনা করেন জনাব সিদ্দিক।
এক্ষেত্রে তিনি একটি স্থানীয় পাওয়ার প্লান্টের উদাহরণ তুলে ধরেন যেটি স্থানীয় নদীর কাছাকাছি না করে একজন রাজনীতিবিদের নির্বাচনী এলাকায় তৈরি করেছেন।
তিনি বলেন, পাওয়ার স্টেশনটিতে অনেক দূর থেকে পানি আনার প্রয়োজন হওয়ায় সেটি চিরতরে বিকল হতে চলেছে।
দুর্নীতির সুযোগ কম
কম্পিউটার ম্যাপিং সিস্টেমটি এধরণের দুর্নীতি প্রতিরোধ করার উপযোগী করে ডিজাইন করা হয়েছে।
ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স ইন বাংলাদেশের সভাপতি জনাব সিদ্দিক বর্ণনা করেন, ম্যাপটি সকলের ব্যবহার করতে পারে। সেখানে কোনো গোপনীয়তা নেই। যেকোনো গোষ্ঠী সেখান থেকে তথ্য পেতে পারে এবং সড়ক কিংবা স্কুলের জন্য তদবির করতে পারে।
‘এই উন্মুক্ততার অর্থ হলো, স্থানীয় কাউন্সিলর তার এলাকার পরিকল্পনা সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল এবং তারা বাজেট যথাযথভাবে খরচ করেছে কিনা সেটি ভালোভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়’।
কাশিমপুর কাউন্সিল নেতা মোহাম্মাদ কলিমুদ্দিন বলেন, ‘এই সিস্টেমটিতে মানুষ উৎসাহিত হয়েছে। আমরা এখন থেকে আর বোকা নই’।
‘আমাদের যে সড়কটি প্রয়োজন ছিলো সেই সড়কটি তারা করেছেন কিনা সেটি এখন দেখাতে হবে। আপনি যা ইচ্ছা তাই করবেন, সেই দিন ফুরিয়ে গেছে। আপনি ফান্ড নিয়ে চলে যেতে পারবেন না’।
আগামীতে ইন্টারনেট সংযোগের সাহায্যে কাউন্সিলে ওয়েবের মাধ্যমে ডিজিটাল ম্যাপস দেখা যাবে। পরবর্তী যুথোপযুক্ত ধাপ হিসেবেই এটিকে দেখছেন স্থানীয় কর্তৃপক্ষ।
মির্জাপুর কাউন্সিলের নেতা আবদুল লতিফ জানান, এই সিস্টেমটি খুব সহায়ক হবে কারণ আমরা জানতে পারবো কী কাজ হয়েছে এবং কোন কাজ বাকি রয়েছে। আমরা যখন এই কাজটি করবো, তখন দুর্নীতির সুযোগ কম থাকবে। আমাদের কাছে সবসময় রেকর্ড থাকবে।
বাইকে জিপিএস
১৯৯১ সালে সর্বপ্রথম নিখুঁত ডিজিটাল ম্যাপ তৈরির কাজ শুরু হয়। সেই সময়ে ১৯৯৬ সালে সেটি শেষ হয়, যা অধিকতর নিখুঁত এবং বিস্তারিত জিওগ্রাফিক নির্দেশিকা প্রদান করে।
বাণিজ্যিকভাবে স্যাটেলাইট ছবি কিনে সেটি ম্যাপে যুক্ত করা হয়।
এই ম্যাপ আপডেট করতে প্রতিবছর ইঞ্জিনিয়াররা মোটরসাইকেলে করে দেশব্যাপী ঘুরে বেড়ান এবং হাতে থাকা গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) ডিভাইস ব্যবহার করে তথ্য যাচাই করেন।
ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে কর্মীরা দেশের ম্যাপ আঁকেন এবং তথ্যগুলো যেমন গ্রামের আকার, স্কুলের অবস্থান অথবা সড়কের অবস্থা যুক্ত করেন।
বিভাগটি দেশের দুই লাখ কিলোমিটার সড়কের দেখভাল করে যেখানে গড়ে ছয়টি সড়কের মধ্যে মাত্র একটি বাঁধানো সড়ক।
বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী শহীদুল হাসান বলেন, আমার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো মানুষের জন্য সবচেয়ে সেরা সুযোগ তৈরি করা, মানুষকে সেবা দেয়া। এই টুলটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ যদি আপনার বেসিক তথ্য না থাকে তাহলে আপনি কীভাবে উন্নয়ন পরিকল্পনা করবেন বলে প্রশ্ন তুলেন তিনি।
ডিবিটেক/বিএমটি