ওআইসি পরিচালিত ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) শিক্ষার্থীরা ৯দফা দাবীতে টানা প্রায় ৩ সপ্তাহ ধরে ক্লাশ ও পরীক্ষা বর্জন করে বিক্ষোভ মিছিল র্যালিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে। এতে ক্রমেই উত্তাল হয়ে উঠছে গাজীপুরের বোর্ডবাজারস্থিত আইইউটি ক্যাম্পাস। আন্দোলনরতরা নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, গাফলতি, শারীরিক, মানসিক ও যৌন হয়রানি এবং অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট ভূক্ত কতিপয় শিক্ষক ও কর্মকর্তার বহিষ্কারও দাবী করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে ওআইসি থেকে একটি প্রতিনিধি দল আগামী ২১ ডিসেম্বর বাংলাদেশে আসছে।
আন্দোলনের সূত্রপাত ২৩ নভেম্বর পিকনিকে যাওয়ার পথে বিদ্যুতায়িত হয়ে তিন শিক্ষার্থী নিহতের পর থেকে। ওইদিন মেকানিক্যাল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং (এমপিই) বিভাগের শিক্ষার্থীদের বহনকারী একটি বাস বিদ্যুতায়িত হয়ে এই হতাহতের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অবহেলার অভিযোগে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন শিক্ষার্থীরা। হতাহতের ঘটনায় বিভাগীয় প্রধানের মন্তব্যে বিক্ষুব্ধ হন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী মোঃ তাইমুম ইবনে সায়েদ, আব্দুল্লাহ আল মিলহানসহ শিক্ষার্থীরা জানান, গত ২৩ নভেম্বর ওআইসি পরিচালিত গাজীপুরের আইউটি’র মেকানিক্যাল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং (এমপিই) বিভাগের বার্ষিক পিকনিকে যাওয়ার পথে শিক্ষার্থীদের বহনকারী একটি ডাবল ডেকার বাস ১১ কেভি বৈদ্যুতিক লাইনের সংস্পর্শে তিনজন নিহত ও ৫জন আহত হয়। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অবহেলার অভিযোগে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। হতাহতের ঘটনায় বিভাগীয় প্রধান (HOD), প্রো ভাইস চ্যান্সেলরের মন্তব্যে ছাত্র ছাত্রীদের মাঝে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। হতাহতের ঘটনায় শোকসন্তপ্ত ছাত্রদের কাঁধে দোষ চাপানোর লক্ষ্যে তারা চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠে। এর জেরে উত্তপ্ত হয়ে উঠে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। একপর্যায়ে গত ২৮ নভেম্বর হতে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। তারা বিভিন্ন দাবীতে টানা তিন সপ্তাহ ধরে ক্লাশ ও পরীক্ষা বর্জন, ফ্ল্যাশলাইট মিছিল, র্যালি ও বিক্ষোভ করে আসছে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, দায়িত্বহীনতা, শারীরিক, মানসিক ও যৌন হয়রানি এবং অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষক ও কর্মকর্তার বহিষ্কার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কার করণসহ ৯দফা দাবী বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন অব্যহত রাখেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল মিলহান জানান, শিক্ষার্থীদের অভিযোগের সাথে যোগ হয়েছে আইউটি’তে ‘চলুক’ (আইউটি ফ্যাকাল্টি ওয়েলফেয়ার সোসাইটি) নামে একটি কথিত অ-অনুমোদিত শিক্ষক ফোরাম রয়েছে। বর্তমান এবং প্রাক্তন ছাত্রদের দাবি অনুযায়ী ওই ফোরামের মাধ্যমে কয়েকজন শিক্ষক ক্যাম্পাসে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। যারা প্রশাসনের উপর নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে প্রায়ই ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত সুবিধার জন্য বিভিন্ন সিদ্ধান্ত হেরফের করতে বাধ্য করেন। যা ছাত্র-বান্ধব উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করেছে এবং তাদের (সিন্ডিকেট) স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছে।
তিনি জানান, ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ছাত্রদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইএসসি (ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস কাউন্সিল) চলমান আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। শিক্ষার্থীরা মনে করে যে তাদের আন্দোলন অহিংসা এবং ন্যায়বিচার ও স্বচ্ছতার নীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তারা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আস্থা ও সততা পুনরুদ্ধারের জন্য জবাবদিহিতা এবং সংস্কারের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী মোঃ তাইমুম ইবনে সায়েদ মেকানিক্যাল এন্ড প্রেডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাচের ছাত্র আরমানি তরফদার আরো জানান, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে লাইনচ্যুত করার জন্য একটি চক্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলে ভুল তথ্য ছড়ানোর অপপ্রচেষ্টা চালাচ্ছে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং ওআইসি প্রতিনিধি দলের প্রতি ইতোমধ্যে আস্থা প্রকাশ করেছে শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করতে ওআইসি থেকে একটি প্রতিনিধি দল শীঘ্রই বাংলাদেশে আসছে। শিক্ষার্থীরা আশা প্রকাশ করছে উপাচার্য এবং ওআইসি প্রতিনিধি দলের সদস্যরা শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো পূরণ করে যথাযথ ও কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে সংকট নিরসনে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করবেন।
তিনি আরো জানান, শিক্ষার্থীরা দাবী পূরণ এবং ন্যায়বিচার ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের সব ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনসহ প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এদিকে আইইউটির উপাচার্য ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম শিক্ষার্থীদের দাবিসমূহের প্রেক্ষিতে জানিয়েছেন যে, তিনি স্বয়ং ওআইসি (অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশন)-এর জেনারেল সেক্রেটারিয়েটে গিয়ে শিক্ষার্থীদের দাবীর বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত আচার্য, ওআইসি’র মহামান্য সেক্রেটারি জেনারেলকে অবহিত করেছেন।
উপাচার্য আরো জানান, শিক্ষার্থীদের দাবির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করে ওআইসি বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে একটি বার্তা প্রেরণ করেছে এবং আইইউটিতে উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল পাঠানোর সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। প্রতিনিধিরা সরাসরি শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে আলোচনা করবে। মহামান্য সেক্রেটারি জেনারেল স্নেহাশিষ শিক্ষার্থীদের শান্ত থাকতে এবং পুনরায় একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করার বিষয়ে আহ্বান জানিয়েছেন।