৩ শিক্ষার্থী নিহত, ৫সদস্যের তদন্ত কমিটি, ৭ জন সাময়িক বরখাস্ত
আনন্দ ডুবলো বিষাদে। বিদ্যুতায়িত হয়ে নিভে গেলো ইসলামিক ইউনিভাসিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) তিন শিক্ষার্থীর জীবন। গাজীপুরের শ্রীপুরের তেলিহাটি ইউনিয়নের উদয়খালী গ্রামে শনিবার (২৩ নভেম্বর) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে একটি পিকনিকের বাসে বিদ্যুৎস্পর্শে জীবন প্রদীপ নিভলো মোজাম্মেল হোসেন নাঈম (২৪), মোস্তাকিম রহমান মাহিন (২২) ও জোবায়ের আলম সাকিবের (২২)।
নিহত তিনজনের মধ্যে মাহিনের বাড়ি রংপুর মহানগরীর জুম্মাপাড়ায়। মাহিন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রংপুরে সামনের সারিতে ছিলেন। তিন সপ্তাহ আগে বাড়িতে এসেছিলেন তিনি। মাহিনের বাবা ইমতিয়াজুর রহমান এবি ব্যাংকের সৈয়দপুর শাখার ব্যবস্থাপক। দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় ছিলেন মাহিন। আইইউটিতে ক্যারিয়ার অ্যান্ড বিজনেস সোসাইটিতে শেষ বর্ষে পড়ছিলেন মাহিন।
মাহিনের ছোটবেলার বন্ধু তাসিম জানান, আন্দোলনের সময় তিন মাস তারা একসাথে ছিলেন। বন্ধুরা মিলে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। মাহিন সবসময় সামনে থাকার চেষ্টা করেছিল। আন্দোলন শেষ হয়ে যাওয়ার পর পরীক্ষা থাকায় সে ঢাকায় চলে যায়। তিন সপ্তাহ আগে হঠাৎ সে বাড়িতে এসেছিল। যাওয়ার সময় খুব তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরবে বলে জানিয়েছিল। বন্ধু যে সারা জীবনের জন্য ফিরবে না তা কল্পনাও করতে পারছেন না তিনি।
মাহিনের চাচা হাসান রহমান জানান, এভাবে মৃত্যু আমরা মারতে মানতে পারছেন না। এই শোক সইবার সাধ্য তাদের নেই। এ ঘটনা শতভাগ অবহেলা । একটা তার ঝুলে পড়বে গায়ের মধ্যে এটা কখনোই মেনে নেয়া যায় না। এর সুষ্ঠু তদন্ত করে এ ঘটনার বিচার চান তিনি।
এ ঘটনায় অন্তত আরও ১০ জন আহত হয়েছেন। আহত ছয়জনকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাখা হয়েছে। তারা প্রত্যেকেই ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (আইইউটি) বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। আহত বাকি চারজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল অ্যান্ড প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বার্ষিক বনভোজন ছিল। রিসোর্ট থেকে আধা কিলোমিটার দূরে বহরে থাকা পাঁচ নম্বর বাসটি বিদ্যুতায়িত হয়। দুর্ঘটনা তদন্তে আইইউটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি এবং ইলেকট্রিক বিভাগের প্রধান রাকিবুল ইসলামকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। বাকি চারজনের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন, রেজিস্ট্রারসহ আরও দুজন রয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রো-ভিসি রাকিবুল ইসলাম বলেন, বছরের পর বছর দ্বিতল বাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পিকনিক করে থাকি। এর আগে এমন কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। দুর্ভাগ্যবশত এবারই প্রথম ঘটল। দুর্ঘটনায় আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা নিশ্চিতে আমরা বদ্ধপরিকর। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, তারা তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেবে।
উপাচার্য অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক। শিক্ষকরা তিনটি মাইক্রোবাসে এবং শিক্ষার্থীরা পাঁচটি দ্বিতল বাসে যাচ্ছিলেন। বহরটিতে পেছনের বাসটি বিদ্যুতায়িত হয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে।’
স্থানীয়দের বরাতে জানা গেছে, শনিবার সকালে গাজীপুর মহানগরীর বোর্ড বাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভাসিটি অব টেকনোলজি (আইইউটি) এর মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের প্রায় ৪৬০ জন শিক্ষার্থী বিআরটিসির ডাবল ডেকার বাসে করে উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের উত্তর পেলাইদ গ্রামের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে যান। বাসগুলোর মধ্যে বিআরটিসি’র ডাবল ডেকারের ৬টি ও ৩টি মাইক্রোবাস রয়েছে। তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো নিয়ে শ্রীপুরের গ্রামীণ আঞ্চলিক সড়ক ধরে রিসোর্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
উত্তর পেলাইদ গ্রামে যাওয়ার পথে বাসগুলো গ্রামীণ সড়কের উদয়খালী বাজারে পৌঁছালে বহরের বিআরটিসির ডাবল ডেকার একটি বাসের উচ্চতা বেশি হওয়ায় উপরে থাকা পল্লী বিদ্যুতের তারের সাথে বাসটির স্পর্শ হয়। এতে বাসে থাকা ৬০/৭০ যাত্রীর মধ্যে কয়েকজন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে আহত হন। পরে দ্রুত তাদের উদ্ধার করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা আফসার উদ্দিন (৭০) জানান, “গাজীপুরের বোর্ড বাজার এলাকার আইইউটির তৃতীয় বর্ষের সাড়ে ৪৬০ জন শিক্ষার্থী ওই এলাকার মাটির মায়া রিসোর্টে ৬টি বিআরটিসি দোতলা বাস এবং তিনটি মাইক্রোবাস নিয়ে পিকনিকে আসেন। তেলিহাটি ইউনিয়নের উদয়খালী গ্রামে পৌঁছানোর পর সড়কের পাশ দিয়ে যাওয়া ১১ হাজার ভেল্টেজের লাইনের সঙ্গে শেষের বাসটি বিদ্যুতায়িত হয়। এ সময় ২ ছাত্র বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলে মারা যান। আহতদের প্রতেকেরই শরীরের বিভিন্ন অংশ বিদ্যুতায়িত হয়ে কারো হাত, কারো পা, কারো মুখ ঝলসে গেছে।”
প্রত্যক্ষদর্শী শামীম আহমেদ, রুবলে মিয়া ও জাকির হোসনের ভাষ্য, সকাল সাড়ে ৮টা, গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের উদয়খালী গ্রামের শান্ত পরিবেশ হঠাৎ-ই খানখান হয়ে যায় আর্ত-চিৎকারে। ঘটনাস্থলের কাছেই নিজ বাড়িতে ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা জাকির হোসেন – ‘আগুন, আগুন’ বলে চিৎকার শুনতে পান। তারা দেখতে পান বিআরটিসি’র একটি ডাবল ডেকার বাস সড়কের পাশের ১১ হাজার ভেল্টেজের লাইনের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। বাস থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। ভেতরে ছাত্ররা চিৎকার করছে। চিৎকার শুনে তারা বাসের কাছে ছুটে যান। বাসের ভেতরে তিনজন ছাত্রকে শকড (বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে স্থবির) অবস্থায় দেখেন, তাদের মধ্যে দুইজনের শরীর একসাথে আটকে ছিল। তখন তারা লক্ষ্য করেন, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ঝুলে থাকা উন্মুক্ত বিদ্যুতের লাইনের (কাভারহীন তারের) সংস্পর্শে এসেছে বাসটি। বাসের মধ্যে থাকা ওই শিক্ষার্থীরা বিদ্যুৎতায়িত হয়েছেন, তখন শুকনো বাঁশ দিয়ে একসাথে শকড হওয়া দুইজনের শরীর আলাদা করেন তারা। পরে বিদ্যুৎ অফিসে ফোন দিয়ে বিদ্যুৎ লাইনের সংযোগ বন্ধ করতে বললে তারা বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেন।
ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর উপ-মহা ব্যবস্থাপক (ডিজিএম) খন্দকার মাহমুদুল হাসান জানান, “ওই লাইটি ১১ হাজার ভেল্টেজের ছিল। সড়কের উপর দিয়ে বিদ্যুতের লাইন ক্রস করা অবস্থায় রয়েছে। একটি বাসকে সাইড দিতে গিয়ে দোতলা বাসটি একটু হেলে পড়ায় বিদ্যুতায়িত হয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে।”
এদিকে, তিন শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় তাদের বাসায় চলছে শোকের মাতম। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় দায়ীদের বিচার চেয়েছেন মাহিনের স্বজনসহ এলাকাবাসী। সহপাঠীদের মৃত্যুর ঘটনায় মুহ্যমান শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
অপরদিকে পিকনিক বাসে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তিন শিক্ষার্থীর মৃত্যু ও হতাহতের ঘটনায় ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর ৭ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এরা হলেন- ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম, সদর-কারিগরি) কমলেশ চন্দ্র বর্মন, মাওনা জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) খোন্দকার মাহমুদুল হাসান, এজিএম মো. তানভীর সালাউদ্দিন, জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার মতিউর রহমান, লাইনম্যান পারভেজ মিয়া শাখাওয়াত হোসেন ও আবুল কাশেমকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড।
ঘটনার পরপরই বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে এই ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) মো. আকমল হোসেন।